বর্তমানে সময়ের এক কঠিন বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্র যেন দেশটির পিছু লেগেছে ছায়ার মতো। একের পর এক আলটিমেটাম, কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং সামরিক হুমকিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তেহরান। যুক্তরাষ্ট্রে প্রশাসন বদলালেও ইরানবিরোধী অবস্থানে বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং আরও সক্রিয়ভাবে চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়েছে ওয়াশিংটন।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ দীর্ঘদিনের। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রসি জানিয়েছেন, ইরানের কাছে এমন উপাদান রয়েছে, যেগুলোর সাহায্যে ছয় থেকে সাতটি পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব। যদিও গ্রসি জানিয়েছেন, ইরানের হাতে এখনো কোনো পরমাণু অস্ত্র নেই।
ইরান নিজের প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (CSIS)-এর ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইরানের কাছে রয়েছে হাজার হাজার ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র। ২০২৩ সালে এক মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা কংগ্রেসে জানান, ইরানের কাছে ৩ হাজারেরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মজুত রয়েছে।
এই সংকটময় সময়ে ইরানের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে দুই পরাশক্তি—রাশিয়া ও চীন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এক বিবৃতিতে বলেন, রাশিয়া ইরানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে এবং আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা নিরসনের সর্বাত্মক কূটনৈতিক চেষ্টা চালাচ্ছে।
চীনও পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পারমাণবিক আলোচনা চালাতে হলে আন্তরিকতা ও পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন করা। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, এই সংকটের সূচনা সেই দেশ থেকেই হয়েছিল, যারা একতরফাভাবে পরমাণু চুক্তি থেকে সরে গিয়েছিল—অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র। চীন প্রত্যাশা করে, সব পক্ষ শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে হাঁটবে এবং বলপ্রয়োগ এড়িয়ে চলবে।
চলমান উত্তেজনার মাঝেই ১২ এপ্রিল ওমানের রাজধানী মাস্কটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের প্রতিনিধি দল পরোক্ষ আলোচনায় বসে। ওমানের মধ্যস্থতায় এই বৈঠকে দুই পক্ষ আলাদা কক্ষে থেকে তথ্য আদান-প্রদান করে। আলোচনায় ইরানের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ।
আব্বাস আরাকচি বলেন, আলোচনার পরিবেশ ছিল গঠনমূলক এবং দুই পক্ষের মধ্যেই ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে। যদিও তিনি এ-ও বলেন যে, ইরান এখনো সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিশ্বাস করে না।
আলোচনার পর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, আলোচনা “মোটামুটি ভালো” চলছে। তবে তিনি আবারও হুঁশিয়ারি দেন, চুক্তি না হলে ইরানকে চরম মূল্য দিতে হবে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারিন লেভিড বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চাইবে না ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকুক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওমানের মধ্যস্থতায় গৃহীত আলোচনা এই জটিল সংকটের মাঝেও একটুখানি আশার আলো জাগিয়েছে। তবে নির্ভর করছে ১৯ এপ্রিলের বৈঠকের ওপর—যেখানে হয়তো নির্ধারিত হবে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ শান্তি, অথবা আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে গোটা অঞ্চল।
ইরান এখন কঠিন সময় পার করছে—যুক্তরাষ্ট্রের লাগাতার চাপ, নিষেধাজ্ঞা ও হুমকির মুখে রয়েছে তারা। কিন্তু এই দুঃসময়ে রাশিয়া ও চীন নিঃশর্তভাবে ইরানের পাশে দাঁড়িয়ে বন্ধুত্ব ও কূটনীতির শক্তি দেখিয়েছে। আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব দেখবে, আলোচনার পথেই কি সংকটের সমাধান সম্ভব, নাকি মধ্যপ্রাচ্য আরও একবার রক্তাক্ত ইতিহাসের পথে হাঁটবে।
তথ্যসূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ